আজ শবে বরাত, হিজরি বর্ষ পরিক্রমার অষ্টম মাস-শাবানের ১৫তম রাত। পূর্ণ একটি বছরের দীর্ঘ পরিক্রমা অতিক্রম করে মহিমাম্বিত, বরকতময় রাতটির আগমন। সারারাত ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আসকার ও তওবা ইস্তেগফারের মধ্য দিয়ে রাতটি পালন করবে মুসলিম সমাজ।
বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে মুসলিম সমাজে ছয়টি রাতকে অধিক গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়। রাতগুলো হলো, জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শবে বরাতের রাত, দুই ঈদের রাত ও শবে কদরের রাত। শবে কদর সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা রয়েছে। অবশিষ্ট রাতগুলো সম্পর্কে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) এক হাদিসে স্পষ্ট বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পাঁচটি রাত এমন আছে যাতে কোনো দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। সে রাতগুলো হলো, জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শবে বরাতের রাত, দুই ঈদের রাত ও শাবান মাসের মধ্যরাত (শবে বরাত)। (মুসান্নেফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৯২৭, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৪৪০, ফাজাইলুল আওকাত, হাদিস : ১৪৯, তারতিবুল আমালি, হাদিস : ১৮৩৮) ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ রাতের মধ্যে শবে বরাত অন্যতম।
হাদিসে রাতটিকে বোঝাতে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান, পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ শাবানের মধ্য রজনী। বস্তুত মাহাত্মের কারণেই বাংলা ভাষাভাষি মুসলমানগণ শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত নামে রাতটিকে স্মরণ করে থাকেন। এ রাতের নফল ইবাদত ও তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে অতীত জীবনের পাপ মোচন হয় এবং জাহান্নাম থেকে নিস্তার লাভ করা যায়।
গুরুত্ব
শবে বরাতের সীমাহীন গুরুত্বের বিষয়টি এর নামকরণ থেকে বোঝা যায়। শবে বরাত নামকরণ ফার্সি ভাষা অনুকরণে হয়েছে, আর লাইলাতুল বরাত হলো শবে বরাতেরই আরবি অনুবাদ। শব ও লাইলাতুন দুটি শব্দেরই অর্থ রাত। আর আরবি ভাষাতে বারাত অর্থ মুক্তি। সুতরাং শবে বরাতের অর্থ মুক্তির রাত। কারণ এই রাতের ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একান্ত নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।
হজরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাতটি (শবে বরাত) আসে, তোমরা রাত জেগে নামাজ (নফল) আদায় করো এবং দিনে রোজা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে আসেন। আর আহ্বান করতে থকেন, আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছ কি কেউ রিজিক প্রার্থনাকারী? আমি তাকে রিজিক দান করব। আছ কি কেউ আরোগ্য কামনাকারী? আমি তাকে রোগ থেকে আরোগ্য দান করব। এভাবে মহান আল্লাহ সূর্যোদয় পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাযা, হাদিস : ১৩৮৮)। সুতরাং যে রাতে মহান আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য আহ্বান করতে থাকেন এবং অপেক্ষা করতে থাকেন, সে রাতটি যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাৎপর্য
শবে বরাতের রাতটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ফজিলতপূর্ণ এই রাতে মহান আল্লাহ বান্দার গুনাহ ক্ষমা করেন ঠিকই কিন্তু নিঃশর্ত ভাবে নয়। মহান আল্লাহর ক্ষমা পেতে তাকে পাশবিক গুণ বর্জন ও ঈমানের দাবি পূরণ করতে হবে। হজরত কাসির ইবনে মুরাহ আল-হাজরামি মাকহুল থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্য রজনীতে (শবে বরাতে) প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং মুশরিক আর হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে ইবনে মাযা, হাদিস : ১৩৯০, মুসান্নেফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৯২৩, মুসান্নেফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৯৮৫৯ ) হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নিসফে শাবানের রাতে (শবে বরাতে) আল্লাহতায়ালা সমগ্র সৃষ্টির প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক আর হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫, মুসনাদে শামিয়্যিন, হাদিস : ২০৫)
সুতরাং আজকের এই মহিমাম্বিত শবে বরাতে সকল মুমিন-মুসলমান নিজ আত্মার সমস্ত খেদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একনিষ্ঠ ভাবে মহান আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হবে, পাশবিক চিন্তা-চেতনা অন্তর থেকে দূর করে দিয়ে মানবিক মূল্যবোধে ভরে তুলবে সেটাই আমাদের কামনা।